হামজা শেখ, রাজবাড়ী :
একটি ব্রীজের অভাবে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের মাধবপুর চরের ১০ গ্রামের অনন্ত ৩৫ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের পদ্মার কোল এলাকায় হিরু মোল্লার ঘাটে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে। ব্রিজ না থাকায় চরের বাসিন্দাদের ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ড বা উপজেলা শহরে যাতায়াতে এখনো একমাত্র ভরসা নৌকা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে হিরু মোল্লার ঘাটে ব্রিজ নির্মাণের কথা শুনে আসলেও তা এখন পর্যন্তও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা খেয়া নৌকায় পারাপার হন। অনেক সময় বাঁশের মাচালী দিয়ে নৌকায় উঠতে বা নামতে গিয়ে অনেকে পানিতে পড়ে যান। একবার খেয়া মিস করলে সর্বনিম্ম আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, ক্লাস, প্রাইভেটে যেতে দেরি হয়ে যায়। এছাড়া নৌকায় রোগী আনা-নেওয়া ও কৃষিপণ্য বাজারজাতে সমস্যায় পড়তে হয়। একটি ব্রিজ হলে চরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটবে।
রতনদিয়া ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক অংশ পদ্মা নদী সংলগ্ন হরিণবাড়ীয়া- মাধবপুর চরে। চরের বাসিন্দারা দিনে খেয়া বা ব্যক্তিগত নৌকায় পারাপার হলেও সন্ধ্যায় নামলেই তারা হয়ে যান বিচ্ছিন্ন এক জনপদের বাসিন্দা। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে কোনোরকম যাতায়াত করা গেলেও বর্ষায় নৌকার বিকল্প নেই। নৌকায় ওঠা-নামার জন্য করা হয়েছে বাঁশের মাচালীর ঘাট, যা খুবই ঝুকিপূর্ণ।
জানা গেছে, রতনদিয়া ইউনিয়নটির প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে পদ্মার কোল চরে (৩, ৪, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড)। এরমধ্যে তিনটি ওয়ার্ডের আংশিক ও দুটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ চরের মধ্যে পড়েছে। সেখানে কয়েকটি স্কুল ও হাট-বাজারসহ রয়েছে প্রায়৩০থেকে ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের সবাইকে উপজেলা শহরে আসতে হিরু মোল্লার ঘাট পাড়ি দিতে হয়। ঘাটের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় দেড়শ গজের মতো।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চরের বেশিরভাগ পরিবারের মূল পেশা কৃষিকাজ। এখানকার উর্বর মাটিতে ভালো ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু একটা ব্রীজ না থাকায় সময় মতো কৃষিপণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয় না।এতে করে কৃষকরা ন্যায্যমুল্যে ফসল বিক্রি করতে পারে না।
ব্রীজ না থাকায় অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সময় মত ক্লাসে বা পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেরি হয়ে যায়। চরের রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া সহ সবার উপজেলা শহরে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা খেয়া নৌকা। আর কোনো বিপদে পড়লে তাদের ভোগান্তির সীমা থাকে না।তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিরা এসে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু নির্বাচনের পর সব ভুলে যান।
শিক্ষার্থী সাথী আক্তার জানান, প্রতিদিন পড়াশোনার জন্য আমাদের এলাকার শতশত শিক্ষার্থীকে কালুখালীতে যেতে হয়। অনেক সময় ঘাঠে এসে খেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।আবার একটা খেয়া মিস করলে কমপক্ষে আধাঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়।এতে করে পরীক্ষা ও প্রাইভেটে সময়মতো পৌঁছাতে সমস্যা হয়।সামান্য এদিক-ওদিক হলে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এতে করে পড়াশোনার উৎসাহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থী।
চরের বাসিন্দা আলাল একজন ঘোড়ার গাড়ির চালক,তিনি ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল আনা-নেওয়া করে সংসার চালায়।কিন্তু ব্রীজ না থাকায় অন্য প্রান্তে যেতে পারেন না।জরুরি প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়ে ওইপাড়ে যেতে হলে ঘোড়াসহ গাড়ি সাঁতরে পানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এতে আয় রোজগার ও কমে গেছে।
মাধবপুর বাজারে মুদি দোকানি সামছুল জানান,দোকানে বিক্রির জন্য নীত্য প্রয়োজনীয় মুদী সামগ্রি আনতে আমাদের কালুখালী যেতে হয়।ব্রীজ না থাকায় কোম্পানির লোক এসে মাল দিয়ে যায় না । তাই আমাদেরই নিয়ে আসতে হয়।অনেক সময় দোকানের মালামাল নিয়ে নৌকা থেকে পরে যাওয়ার ভয় থাকে।মাঝেমধ্যে অনেকেই পড়ে যান। একটা ব্রীজ থাকলে তাদের এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
চরের পশ্চিম কামিয়া গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, কৃষিকাজ করে আমার সংসার চলে। কিন্তু যে ফসল ফলাই তা বিক্রিতে খুব কষ্ট করতে হয়। ফসল কালুখালীর বাজারে নিতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। আবার অনেক সময় নৌকা থেকে কৃষিপণ্য পানিতে পড়ে যায়। একটি ব্রিজ থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে ফসল বিক্রি করতে পারলে দামও ভালো পেতাম।হিরু মোল্লার ঘাটে একটি ব্রিজ আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গৃহবধূ আনিকা খাতুন জানান, তার বাবার বাড়ি চরে, আর শ্বশুরবাড়ি কালুখালীতে। শিশু সন্তান নিয়ে নৌকায় আসা-যাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। আবার খেয়া নৌকা না পেলে দীর্ঘসময় ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।এখানে একটা ব্রীজ হলে আমাদের এই ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
রতনদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাচিনা পারভীন নিলুফা কালবেলাকে জানান, হিরু মোল্লার ঘাঠে ব্রিজ না থাকায় চরের বাসিন্দারা কৃষিপণ্য বাজারে আনা-নেওয়াসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্রিজটি নির্মাণ হলে কৃষিপণ্য বাজারজাতসহ সব ধরনের সুবিধা পাবে চরবাসী। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হবে।
কালুখালী উপজেলা নির্বাহীপ্রকৌশলী (এলজিইডি) মো. তৌহিদুল হক জোয়ার্দ্দার কালবেলাকে বলেন, দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া শেষ হলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খুব দ্রুত কাজ শুরু হবে।