মোঃ মুকিম উদ্দিন জগন্নাথপুর প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় মুজিব পল্লীর ঘর নির্মাণে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সাবেক উপজেলা কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও এই মুজিব পল্লীর ঘর নির্মাণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ইউএনও’র ইচ্ছায় দেওয়া মুজিব পল্লীর ঘর নির্মাণ প্রকল্পের কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রিপন ও মুন্না এখন কোথায় এ নিয়েও এলাকায় রয়েছে আলোচনা সমালোচনা। সম্প্রতি মুজিব পল্লীর ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হলেও ২৬ লাখ টাকা মজুরি না পেয়ে সাবেক ইউএনও সাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন এক ঠিকাদার। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, সরকারি টাকা নিয়ে রিপন ও মুন্নাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসনই। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন ভুইয়াও বলেছেন, প্রশাসনের অবেহলায়ই রিপন ও মুন্না পালিয়েছে।
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে একটি ছিল ভূমিহীন হতদরিদ্রদের মধ্যে মুজিব পল্লী নামের আশ্রয়ণ প্রকল্প। সারাদেশের ন্যায় জগন্নাথপুর উপজেলায়ও এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম এই প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করেন। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সদস্য সচিব হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা অনেক উপজেলায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ও কমিটির দায়িত্বশীলরা মিলে এই কাজ বাস্তবায়ন করলেও জগন্নাথপুর উপজেলায় প্রকল্পের ঘর নির্মাণের মালামাল ক্রয় থেকে শুরু করে সকল কার্যক্রম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর ইচ্ছেমতই করেন। তিনি নিজে গিয়ে উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের শাপলা ব্রিক ফিল্ড থেকে প্রথমে সাড়ে আট লাখ ইট কিনেন। সরকারি কাজের দোহাই দিয়ে ৯ হাজার টাকা চুক্তিতে ইট কিনে, বিল করেন তিনি ১১ হাজার টাকা করে। প্রতি এক হাজার ইট থেকে দুই হাজার টাকা করে কমিশন নেন ইউএনও। এতে করে ইট কেনা বাবদ প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এসময় শাপলা ব্রিকফিল্ডের ম্যানেজার পাইলগাঁও ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের আবদুল বাকিরের ছেলে মুন্না মিয়া ও একই গ্রামের আলা উদ্দিনের ছেলে রিপন মিয়ার সঙ্গে তার গভীর সখ্য গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে মুজিব পল্লীর ইট, বালু, পাথর এবং দরজা—জানালার জন্য শাপলা ব্রিক ফিল্ডের ম্যানেজার মুন্না মিয়া ও রিপন মিয়াকে দেড় কোটি টাকা অগ্রিম দেবার কথা বলে পিআইও অফিসকে চেক দিতে বলেন ইউএনও সাজেদুল ইসলাম। আনুমানিক ৫০ লাখ টাকার কাজ বুঝে পাবার পর এক কোটি টাকা নিয়ে হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যায় মুন্না ও রিপন। অভিযোগ উঠেছে ইউএনও সাজেদুল ইসলামই টাকা হাতিয়ে তাদের বিদেশ পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করেন। পরে এই টাকা তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে এনে সমন্বয় করে কাজ করান। ঘটনার পর মুন্না ও রিপনের বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি ছাড়া অন্য আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয় নি। শাপলা ব্রিক ফিল্ডে অভিযান চালিয়ে একটি ট্রাক্টর আটক করলেও, পরে ব্রিকফিল্ডের মালিকপক্ষের সঙ্গে টাকা লেনদেনের কোন প্রমাণ দেখাতে না পারায় ট্রাক্টরটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। জানতে চাইলে শাপলা ব্রিক ফিল্ডের স্বত্বাধিকারী যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফারুক আহমেদ বলেন, আমি একজন প্রবাসী, দেশে ও প্রবাসে যাওয়া আসা করি। ম্যানেজার রেখে ব্যবসা চালিয়ে আসছি। সাড়ে আট লাখ ইট কেনার জন্য ইউএনও সাজেদুল ইসলাম আমার সঙ্গে কথা বলে চুক্তি করেন। প্রতি হাজার ইটের টাকা থেকে তিনি দুই হাজার টাকা কমিশন নেন। আমাদের কে নয় হাজার টাকা দিয়ে, বিল করান ১১ হাজার টাকা করে। পরে তিনি মুন্না ও রিপনের সঙ্গে টাকার লেনদেন করেছেন দাবি করেছেন। এই লেনদেনে আমার ব্রিকফিল্ডের কোন ডকুমেন্টস নেই বা আমার সঙ্গে এ নিয়ে তিনি কোন কথা বলেন নি। বিষয়টি মুন্না, রিপন ও ইউএনও সাজেদুল ইসলামের ব্যক্তিগত ভাগবাটোয়ারার বিষয় ছিল। তিনি বলেন, মুন্না ও রিপন পালিয়ে যাওয়ার পর ইউএনও আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রাক্টর আটক করে থানায় নিয়ে যান। কোন প্রমাণ বা আমার প্রতিষ্ঠানের রশিদ দেখাতে না পেরে ট্রাক্টরটি ফেরত দেন।জগন্নাথপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন বললেন, মুজিব পল্লীর ঘর নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি করা হয়েছিল। আহ্বায়ক ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সদস্য সচিব পিআইও, সদস্য রাখা হয়— উপজেলা প্রকৌশলী, এসিল্যান্ড ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে।এই কমিটি খুব একটা কাজে লাগেনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব প্রকল্পে আয়ন—বায়ন কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়ায় টাকা পয়সার লেনদেন তিনি একাই করেছেন। মালামাল কেনায়ও আমাদের যুক্ত করেন নি। কেবল কাজ বাস্তবায়ন করার বিষয়টি আমরা দেখভাল করেছি। মুন্না ও রিপনকে দফায় দফায় টাকা দেবার জন্য চেক করার নির্দেশ দিলে, একপর্যায়ে আমি বলেছি, ওরা সময়মত মালামাল দেয় নি। আমাদের পাওনা রয়েছে টাকা। তবুও তিনি ৬০ লাখ টাকার চেক দেবার কথা বলেন এবং জানান মালামাল দিলো কী—না আমি (ইউএনও) বুঝবো। পরে আমরা চেক অগ্রয়ণ করি।তিনি জানান, সময়মত মালামাল না পাওয়ায় ইউএনও সাহেবকে অবহিত করেছি আমরা। এরা পালিয়ে যেতে পারে, গা—ডাকা দিতে পারে এটিও জানিয়েছি। দুই বছর আগের একটি মিটিংয়ে জানিয়েছিলাম, ওরা পালাবে পাসপোর্ট জব্দ করা হোক। তিনি (ইউএনও) তখন বলেছেন, মাটির নীচ থেকে বের করে আনবো। দেড় বছর আগে একজন পালানোর পর, তিনি বললেন, অন্যজনকে যেনো নজরে রাখি। পিআইও বললেন, আসলে ভেতরে আরও ঘটনা আছে, যেগুলো প্রমাণ ছাড়া বলা ঠিক হবে না।শাহাদাৎ হোসেন বললেন, সর্বশেষ বিদায়বেলা ইউএনও সাহেব (সাজেদুল ইসলাম) আমাকে ডেকে নগদ ২৫ লাখ টাকা দিয়ে যেতে চাইলেন। তখন মুজিব পল্লীর তহবিলে ছিল ৩০ লাখ টাকা। তাঁর দেওয়া ২৫ লাখসহ ৫৫ লাখ টাকা হয়। আমি বললাম, কাজ করাতে হবে কমপক্ষে পৌনে দুই লাখ টাকার। আমি সেই টাকা রাখিনি। এক পর্যায়ে ইউএনও এসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দিয়ে ওই টাকা বুঝিয়ে বিদায় নেন তিনি। এরপর বহুদিন এই পল্লীর কাজ বন্ধ থাকে। এরকম অসমাপ্ত কাজই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নির্মাণ কাজ শেষ দেখিয়ে উদ্বোধন করানো হয়।পরবর্তীতে এই কাজ শেষ করার জন্য নানা উর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষ নির্দেশ দেন। সরকার পরিবর্তনের কিছুদিন আগে নতুন ইউএনও আল বশিরুল ইসলাম আসার পর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি নিয়ে বসেন। কমিটির সিদ্ধান্তে ইউএনও’র দেওয়া ২৫ লাখ ও তহবিলের ৩০ লাখ টাকা নিয়েই কাজ শুরু করি আমরা। শেষে দুই দফায় ইউএনও সাজেদুল ইসলাম ৭৪ লাখ টাকা দেন। সম্প্রতি তিনি আরও সাড়ে ১২ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন এবং তাতে কাজ শেষ হয়েছে। কিছু মালামাল সরবরাহকারী’র বকেয়া টাকা পাওনা ছিল, এগুলো ইউএনও (সাজেদুল ইসলাম) নিজ দায়িত্বে পরিশোধ করেছেন। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। ইউএনও অন্য কোন প্রকল্পের টাকা এখানে লাগিয়েছেন এমন তথ্য আমার জানা নেই।জগন্নাথপুর উপজেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক এম এ কাদির বললেন, স্থানীয়ভাবে আলোচনা আছে মুন্না ও রিপনের সঙ্গে সাবেক ইউএনও’র অর্থ ভাগবাটোয়ারা’র সম্পর্ক ছিল। তাদেরকে আসলেই তিনি টাকা দিয়েছেন কী না, তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে প্রমাণ হয় নি বা কোন ডকুমেন্টসও নেই। সেই ক্ষেত্রে এই টাকা আসলে কে নিয়েছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতেও সরকারি অন্য প্রকল্পের টাকা কাজে লাগানো হতে পারে মনে করেন অনেকে। এই বিষয়ে তদন্ত করে সরকারি টাকা লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানালেন তিনি।
জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. জিয়াউর রহিম শাহীন বললেন, জগন্নাথপুরের মুজিব পল্লী নিয়ে বহু কথা ইতোমধ্যে নানাভাবে শুনেছি। এই প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে মনে করেন অনেকেই। তদন্ত সাপেক্ষে অনিয়মের সঙ্গে জডড়তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এদিকে, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবাননগর ইউনিয়নের হাছানবাহার গ্রামের আমজাদ আলী সম্প্রতি এই প্রকল্পে ঘর নির্মাণ ও মাটি ভরাট কাজের ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে বলে জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ করেছেন।উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন ভূঞা অবশ্য বলেছেন, আমজাদ হোসেনের অভিযোগ সত্য নয়। তাকে তাঁর ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।সাবেক ইউএনও সাজেদুল ইসলাম (বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত) বললেন, এই পল্লীর ঘর করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পডড়। আমি কোন অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হইনি। আমার সঙ্গে মুন্না—রিপনের অনৈতিক কোন সখ্যতা ছিল না। কাজ আদায় করার জন্যই সবকিছু করেছিলাম আমি। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন হওয়ায় এসব বিষয় নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না। মুন্না ও রিপনের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরা দেশের বাইরে চলে গেছে, কোথায় কবে গেছে, এটি তিনি জানাতে পারেন নি। তিনি জানান, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদ বিক্রয়ের টাকাও তিনি এই খাতে ব্যয় করেছেন।জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বললেন, আমি নতুন এসেছি। অনেক কিছুই আমার জানা এখনো সম্ভব হয়নি। জগন্নাথপুর মুজিব পল্লীর বিষয়েও আমার তেমন কিছু জানা নেই। কোনও ঠিকাদার টাকা পান নি বলে অভিযোগ দিয়ে থাকলেও আমি সেটি এখনো দেখিনি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: হাসান ইমাম তালুকদার
মোবাইল: 01711412874, 01712197481
ঢাকা অফিস: ৫০/১,পল্টন লাইন, পুরানা পল্টন,পল্টন, ঢাকা।
সিরাজগঞ্জ অফিস: হাউস নম্বর ৪০, মায়া কুঞ্জ, মোক্তার পাড়া, সিরাজগঞ্জ।
Design & Development By HosterCube Ltd.