বিপ্লব কুমার দাস।
উপদেষ্টা ও নিজস্ব প্রতিবেদক বাংলাদেশ।
দেশে নতুন আতঙ্কের নাম অনলাইন জুয়া। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জুয়া খেলা বহু পুরনো এবং প্রচলিত এক প্রকার অবসর-বিনোদনের মাধ্যম। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে জুয়ার অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে অনলাইন জুয়াতেই এখন মানুষের অংশগ্রহণ বেশি। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে অনলাইন জুয়া খেলা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্কুল-কলেজে পড়য়া শিক্ষার্থীরাও ঝুঁকে পড়ছে এই অনলাইন জুয়ায়। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে চলে এসব জুয়ার আসর। মোবাইল ফোনে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস ডাউনলোড করে সেই অ্যাপসের লিংক অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চালানো হয় জুয়া।
ওয়ানএক্সবেট, বেটবাজডট৩৬৫, ক্রিকেক্স, বেট৩৬৫এনআই ও মসবেটসহ বিভিন্ন জুয়ার সাইটে টাকা পাচার হচ্ছে। প্রথমে অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে শুরু করে খেলা। এক পর্যায়ে লোভে পড়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। মাঠে-ঘাটে, হাট-বাজারে এমনকি পাড়ার চায়ের দোকানে একপ্রকার প্রকাশ্যেই বসে অনলাইন জুয়ার আসর। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই কোনো সুনিদ্দিষ্ট তথ্য।
উপজেলার বিপ্রকয়া গ্রামের একজন জুয়াড়ি জানান, আমি একজন ভ্যান চালক, লোভে পড়ে ছয় মাস আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার সাথে পরিচয় ঘটে। এরপর একে একে বাড়ির গোয়ালে থাকা চারটি গুরু বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা খোয় গেছে সাথে আমর উর্পাজনে মাধ্যম ভ্যানটাও চলে গেছে । এখন বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা দুস্কও হয়ে পড়েছে আমি পুরোপুরি নিঃস্ব।
উপজেলার ভবানিগঞ্জ কলেজের একজন শিক্ষার্থী বলেন, লোভে পড়ে বিভিন্ন অযুহাতে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে অনলাইন জুয়া খেলে সব টাকা নষ্ট করে ফেলেছি । একবার আমি (৫০০) পাঁচশত টাকা দিয়ে বেট / বাজি ধরে ৩০০০/= তিন হাজার টাকা জিতি, তারপরে জেতার লোভ আমাকে পেয়ে বসে, য়ার ফলে কলেজের নাম করে বাড়ি হতে অনেক টাকা নিয়ে আমি এখানে বাজি ধরি কিন্তু আর কোন বাজিতে আমি জিতিনি । জুয়ার টাকা জোগাড় করতে না পেরে আমার কিছু বন্ধুরা পা বাড়াচ্ছে অপরাধ জগতে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। আমার বন্ধুরা সবাই এখন এই অনলাইন জুয়া খেলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক ও উপজেলার একডালা গ্রামের বাসিন্দা জানান, আমার ছেলে প্রথমে ফ্রী ফায়ার ও পাবজি গেম খেলতো। এখন বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে নিয়মিত জুয়া খেলে খলে। কিছু বলতে গেলে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। তিনি জানান, জুয়ায় আর্থিক লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পেমেন্ট করার সুযোগ রয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও লেনদেন করা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাহেরপুর পৌরসভার তাহেরপুর বাজারের একজন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট বলেন , আমার কাছে ভ্যানচালক , কৃষক, দিমজুর ,চাকুরিজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এই অনলাইন জুয়ার জন্যে প্রচুর পরিমাণে টাকা লেনদেন করে, আমি বিকাশ নগদের মাধ্যমে এ ধরনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করি এতে করে প্রতিদিন আমার কাছ থেকে তাহেরপুর বাজারে কমপক্ষে দিনে গড় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে । এই বাজারে আমার মতো আরো এজেন্ট আছে, আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি তবে আমার পরামর্শ এই ধরনের অনলাইন জুয়ায় আসক্ত না হওয়ার ।
শুধু বাগমারা উপজেলাতে নয় পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এই অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ থাবা , শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কৃষক দিনমজুর ভ্যানচালক, চাকুরিজীবী এমনকি ব্যবসায়ীরাও জড়িয়ে পড়েছে এই অনলাইন জুয়াতে। অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ টাকা উপার্জনের জন্যে তারা এই ধরনের অনলাইন অবৈধ ওয়েবসাইট গুলোতে বাজি/জুয়া খেলছে ।
পুঠিয়া উপজেলার শিলমাঢ়িয়া ইউনিয়নের মঙ্গল পাড়া গোবিন্দ পাড়া গ্রামের একজন জুয়াড়ির সাথে মুঠো ফোনে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সে তাহেরপুর বাজারে এক দোকানে সেলসম্যান এর কাজ করতেন, এক বন্ধুর মাধ্যমে এই অনলাইন জুয়ার ব্যপারে জানতে পারে, প্রথমে সে কিছু টাকা এখান থেকে পেলেও পরবর্তীতে এই লোভে পড়ে তার দোকানের মালিক তাকে ২০০,০০০/= ( দুই লক্ষ টাকা ) ব্যাংকে জমা করতে পাঠিয়ে ছিল, দোকানের সেই টাকা সে ব্যাংকে জমা না করে জুয়ার খেলে ২০০,০০০/= ( দুই লক্ষ টাকা ) সব হেরে যায়, টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সে দীর্ঘদিন এলাকা থেকে পলাতক ।
শুধু তাই নয় একই গ্রামের ভ্যানচালক মোঃ রবিউল ইসলাম আনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে তার ভ্যান বিক্রি করেছে এবং তার জমি ছিল প্রায় দশ কাঠা সেই জমিও বিক্রি করেছে এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন নিয়ে বর্তমানে তার পরিবারসহ পালাতক।
এই অনলাইন জুয়ার থাবা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বত্র তাই সমাজের সকলকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সন্তানরা কোথায় কখন কিভাবে কি করছে মোবাইলে কতটুকু সময় দিচ্ছে এবং সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই হয়তো বা রোধ করা যেতে পারে এই জুয়ার ভয়াবহ থাবা।
পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, জুয়ার জন্য জুয়ারি তিন মাসের কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারে। মানুষকে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকেই পুঙ্গ করে মেরে ফেলার মতো মানববিধ্বংসী এই মোবাইল জুয়া কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। তাই সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ।
এ ব্যাপারে বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে আমি শুনেছি অনলাইন জুয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আমরা চেষ্টা করছি এজন্টেদেরকে ধরতে। তাদেরকে ধরতে পারলে অনলাইন জুয়ার প্রসার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।