আবিদ হাসান, জামালপুর জেলা প্রতিনিধি:
জামালপুরের ইসলামপুরে চারটি পরিবারে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১০ জন সদস্যই মুখজুড়ে লম্বা লোম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বংশগতভাবে এসব পরিবারের সদস্যরা মুখ এবং শরীরে লম্বা লোম নিয়ে কষ্ট করলেও অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় প্রতিনিয়তই হতাশায় দিন কাটে তাদের।
জানা গেছে, পৌর শহরের উত্তর দরিয়াবাদ ফকিরপাড়া গ্রামের চারটি পরিবারের কমিলা বেওয়া, শিরিনা আক্তার, জুনাব আলী, মমতাজ উদ্দিন, করিম শেখ, আক্রাম আলী, নজরুল, জুলেখা আক্তার, আকাশ ও আসাদ এই ১০ জন নারী-পুরুষ সদস্যই মুখজুড়ে লম্বা লোম নিয়ে জন্ম থেকেই কষ্ট আর বিড়ম্বনার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। এলাকায় তাদেরকে ‘লোমমানব’ বলে কটাক্ষ করা হয়ে থাকে।বংশগতভাবে এসব পরিবারের সদস্যরা মুখ এবং শরীরে লম্বা লোম নিয়ে প্রায় ২০০ বছর থেকে সমাজে অবহেলিত হয়ে আজও প্রতিনিয়তই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সমাজে অবহেলিত হয়ে দিন কাটালেও আর্থিক অস্ব”ছলতার কারণে তারা চিকিৎসা করাতে পারেননি।সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শিরিনা আক্তার বয়সে ২৮ বছর হলেও লম্বায় মাত্র আড়াই ফুট। বাঁকা মেরুদন্ডের উপর বিশাল কুঁজো আর মুখজুড়ে তার লম্বা দাঁড়ি। প্রথম দেখায় পুরুষ ভেবে যেকোনো মানুষের ভুল হলেও মুখজুড়ে লম্বা লোম নিয়েই জন্ম হয় শিরিনার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক উচ্চতা না বাড়লেও মুখের লোম ক্রমেই বেড়ে দাঁড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠীরা তাকে নিয়ে উপহাস করলেও তিনি মনে চেপে রাখতেন কষ্ট। বাবা সিরাজ শেখ মারা যাওয়ায় অভাবের সংসারে যেখানে দু-বেলা খাবার জোটে না সেখানে চিকিৎসা করানোটা স্বপ্নাতীত। এমন দুর্বিষহ জীবন শুধু শিরিনার একার নয়।
তার মা কমিলা বেওয়া (৬০), ভাই করিম শেখ (৩৮), চাচা জোনাব আলী (৫৪), তার মেয়ে জুলেখা আক্তার (২৬), ছেলে আক্রাম (১৭), নজরুল (১২), মমতাজ আলী (৩৬), তার ছেলে আকাশ (১২) এবং আসাদেরও (১০) একই অবস্থা। তারা একই বংশের চার পরিবার। প্রজন্মের পর প্রজন্মে তারা সবাই মুখসহ সারাদেহে এমন অস্বাভাবিক লোম নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। অতীতে তাদের বাপ-দাদারা এভাবেই জীবন যাপন করে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তাই তারা এই বিরল রোগের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করাতে পারেনি।কমিলা বেওয়া বললেন, আমার এক ছেলে এবং মেয়ে দু’জনের মুখেই অস্বাভাবিক লোম। ছেলের শরীরের চেয়ে মেয়ের লোম বেশি। তার উপর মেয়ে শিরিনার মেরুদন্ড বাঁকা এবং কুঁজো থাকায় ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না। প্রায় ২৫ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ায় উপার্জন করার মতো মানুষ না থাকায় অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছি।জুলেখা আক্তার বললেন, টাকার অভাবে বাবা চিকিৎসা করাতে পারে না।
অভাবের কারণে নবম শ্রেণিতে থাকতেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। মুখে ছেলেদের মতো দাঁড়ি হওয়ায় মানুষ আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করে। তখন খুবই কষ্ট হয়।তারা আরও জানান, অবজ্ঞা আর অবহেলার মধ্যে বেঁচে থাকলেও সরকারের দেওয়া কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা এখনো পায়নি। শুধু প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কুঁজোবিশিষ্ট শিরিনাই প্রতিবন্ধী ভাতা পান।বংশগতভাবে অনেকে মৃত্যুবরণ করলেও বর্তমানে এই চারটি পরিবারের ১০ জন সদস্যই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। তারা উন্নত চিকিৎসা সহায়তার জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
তাদের সম্পর্কে সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আঃ রাজ্জাক লাল মিয়া বললেন, আমরা ছোটোকাল থেকেই তাদের লোমযুক্ত দেখে আসছি। তাদের বাপ-দাদারা এমনই ছিলেন। আসলে তারা গরিব মানুষ। নুন আনতে পানতা ফুরায়। কিভাবে তারা চিকিৎসা করবে। তাদের পেটের ভাত যোগাড় করতেই দিন চলে যায়। অন্যদিকে তারা সমাজে অবহেলিত। তারা চলছে অবজ্ঞা, অবহেলা আর বঞ্চনার মধ্য দিয়েই। তাদের প্রতি প্রশাসন দৃষ্টি দিলে হয়ত ভালমতো চলতে পারতেন।ইসলামপুর পৌরসভার কাউন্সিলর জুলহাস মন্ডল বললেন, আমরা ছোটোকাল থেকেই তাদেরকে লোমযুক্ত দেখছি। তারা চিকিৎসা করাবে এ ব্যাপারটা আমাদের কখনো বলেননি। তবে তারা অবহেলিত। তাদের জন্য সমাজের বিত্তবানেরা এগিয়ে এলে হয়ত তারা ভালমতো জীবন ধারণ করতে পারতেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম বললেন, ইসলামপুরে লোমশ পরিবার আছে বিষয়টি জানি না। তবে পরিবারগুলো যোগাযোগ করলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।