অথই নূরুল আমিন:
মানব জাতির ইতিহাসে মানবতা মানবজীবনের বহু গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম, যার সাহায্যে মানুষেরা তাদের ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি লাভ করে থাকেন। তবে এই মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যা বা জ্ঞান।
কারণ বিদ্যার তুলনায় আর কোন ধন নেই, ধৈয্যের তুলনায় যেমন কোন সন্তুষ্টি নেই, তেমনি আপন অবস্থাতে তুষ্টির মত নেই কোন ঐশ্বর্য, ইন্দ্রিয় শক্তি দমন করার মত নেই কোন বড় যুদ্ধ, ভক্তির মত নেই কোন সাধুতা, কার্পণ্যের মত নেই কোন দোষ, হিংসার মত নেই কোন রোগ, ভদ্রতার মত নেই বড় গুণ, ভাগ্যের মত নেই কোন শক্তি এবং ভিক্ষার মত নেই অপমানজনক কর্ম।
বিদ্যা বা জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর- নারীর উপর ফরজ। কেননা মানুষ ও পশুর মধ্যে মূলত পার্থক্য হলো বিদ্যা বা জ্ঞান। তাই বিদ্যা অর্জন করতে পারলে মানবতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বিদ্যা উপার্জন করে, সে অবশ্যই ধর্ম-কর্ম দুটিই করে থাকেন । আর যে ব্যক্তি বিদ্যা আলোচনা করেন, সে আল্লাহর প্রসংশা করেন। যে বিদ্যা শিক্ষা দেন, দান করার মত পুন্যের অধিকারী হয়ে থাকেন ।
যে ব্যক্তি উপযুক্ত পাত্রে বিদ্যা দান করেন, তিনি আল্লাহ পাকের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করেন। বিদ্যায় ভালো মন্ধ বিবেচনা করার শক্তি এনে দেয়। বিদ্যা জান্নাতের পথ আলোকিত করে তোলে। বিদ্যা নির্জনের সঙ্গী এবং মরুভূমিতে সহচর। তা মানুষকে নির্মল আনন্দের দিকে নিয়ে যায়। শত দুঃখ ‘বিপদের মাঝে তা আশ্রয় স্বরূপ এবং শত্রুর সম্মুখীন হওয়ার অমোঘ রক্ষাকবচ।
যারা এ পৃথিবীতে অন্ধ অর্থাৎ যারা সত্য মিথ্যার, ধর্ম- অধর্ম, পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির বিচার করতে পারে না বা করে না, তারা পরকালে অন্ধ থাকবে; আর তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বিপদগামী। তাই মানবতা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আজকের অশান্তির অনলে দগ্ধীভূত পৃথিবীতে শান্তি ‘প্রতিষ্ঠার লক্ষে বিদ্যা বা জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই।
মানুষের কর্মময় জীবনে দায়িত্ব ও কর্তব্যের শেষ নেই। ব্যক্তিগত কর্তব্য হতে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য কর্তব্য মানুষকে পালন করতে সকল সময়ই তাকে নানা রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কর্তব্যের প্রতিকুল স্বার্থ ও পক্ষ যত বড় হয়, বাধা তত বড় এবং মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। তাই সকল বাধা বিপত্তি, অত্যাচার ও প্রতিকুল অবস্থার মাঝে অবিচল চিত্তের কর্তব্য পালনে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করার ফলশ্রুতিতে যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়- তা প্রকৃতই অতুলনীয় মানবতার নিদর্শন।
রূপ, যৌবন, সম্পদ ও শক্তি দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় না; হয় মানবতা দ্বারা। আসলে সহনশীলতা তথা মানবতা এনে দেয় শান্তি, স্থিতি ও সফলতার অনুপম সুযোগ। মানবতার আর এক অন্যতম উপাদান হলো- আত্মতুষ্টি এবং আপন অবস্থাতে সন্তুষ্ট থাকা। আত্মতুষ্টি বা আপন অবস্থাতে প্রতিষ্ঠিত এমন ঐশ্বর্য, যার লয় নেই, ক্ষয় নেই, কোন রকম ব্যয় নেই।’দুনিয়ার অর্জিত ও প্রাপ্ত সম্পদ ভিত্তিক ঐশ্বর্যের পতন অনিবার্য। কিন্তু আত্মতুষ্ট পরিপুত ঐশ্বর্য সর্বত্র সমভাবে অক্ষয় ও অটুট থাকে।
সোনার হার পরিধান করে পরের হুকুমে দন্ডায়মান থাকা অপেক্ষা, শুকনো রুটি খেয়ে স্বাধীন ভাবে আপন অবস্থাতে তুষ্ট থাকা অনেক ভালো । যারা আপন অবস্থাতে তুষ্ট থাকতে পারে না বা থাকতে চায় না, তাদের মন মানষিকতা কখনও কলুষমুক্ত হতে পারে না। এজন্যই তাদের স্থান হয় পাপাচারী ও নিকৃষ্টদলের মাঝে। তাদের দ্বারা মানবতার কোন কল্যাণ হয় না বরং অকল্যাণই হয়ে থাকে। এ মানবতা বিরোধী পাপাচার মানুষের জীবনে অধঃপতনের যে ধস নেমে আসে তা কখনও প্রতিরোধ করা যায় না।
রোগের শেষ, আগুনের শেষ, ঋণের শেষ ও শত্রুর শেষ থাকলেও আত্মতুষ্টি বিবর্জিত ব্যক্তিসত্তার বিপদ ও সংকটের কখনও শেষ হয় না, হতে পারে না। একের পর এক আঘাতে, সে ক্ষত-বিক্ষত ও চৌচির হয়। পরিণামে তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে চির অশান্তি বিরাজ করতে থাকে। তারাই মানবতা বিধ্বংসী মরণাস্ত্র। আমাদের দেশ ও জাতির স্বপ্ন হোক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধারক ও বাহক যুব সমাজকে একদিকে মানবতার দীক্ষা মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে অপর দিকে মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ থেকে কলুষমুক্ত রাখতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে আমরা একটি সুন্দর জাতি ও সুশৃংখল সমাজ উপহার পাব।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট