নাজমুল হোসেন
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
সিরাজগঞ্জ সলপের ঐতিহ্যবাহী ঘোলের চাহিদা রয়েছে এখন দেশজুড়ে।রমজান উপলক্ষে সলপের ঐতিহ্যবাহী ঘোলের দোকান গুলোতে চলছে জমজমাট ব্যবসা। রোজার শুরু থেকেই ইফতার আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী ‘সলপের ঘোল’ কদর পাচ্ছে। প্রতিদিনই ঘোলের চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে ঘোল কারখানার কর্মীদের কাজও বেড়ে গেছে অনেক গুণ। সুস্বাদু পানীয় খ্যাতি পেয়েছে ‘সলপের ঘোল’ নামে । এই জনপদে নয়, দূরদূরান্তে ছড়িয়ে আছে সলপের ঘোলের সুনাম।
উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের পাশে ঘোলের দোকানগুলো জমে উঠেছে। দোকানের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র সাজিয়ে চলছে বিক্রি। দোকানের পেছনে কর্মীরা ঘোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে এই ঘোলের জন্য এখানে এসেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে তৎকালীন সলপ সান্যাল জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সলপে ঘোলের কারখানা গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সলপ থেকে কলকাতা যেত এই ঘোল। সেই সময় থেকেই সলপের ঘোলের খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। এখনও সলপের ঘোল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
প্রযুক্তি ও সভ্যতার বিকাশে এখন ফ্রিজিং করে ঘোল পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে ক্রেতারা নিশ্চিন্তে ঘোল নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে । সলপে এখন ৮/৯টি ঘোলের কারখানা রয়েছে। উৎপাদিত এ ঘোল নিয়মিতই বিক্রি হয়ে থাকে। কারখানার মালিকদের মধ্যে রাঘববাড়িয়া গ্রামের আব্দুল মালেক, আব্দুল খালেক, মাটিকোড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, বেতকান্দি গ্রামের জলিল ও ভদ্রকোল গ্রামের মোহাম্মাদ আলীর কারখানায় বেশি ঘোল উৎপাদিত হয়ে থাকে বলে জানান।
এই ঘোল বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে এক কারিগর সাদ্দাম বলেন, প্রতিদিন ভোরে গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেওয়ার পর পাত্রে করে সারা রাত রেখে দেওয়া হয় সেই দুধ। সকালে জমে থাকা সেই দুধের সঙ্গে চিনি ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই সুস্বাদু পানীয়।
ঘোল বিক্রেতারা বলেন, প্রতিদিন সলপ রেলস্টেশন এলাকায় ১৫০ থেকে ২০০ মণ ঘোল ও মাঠা বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার ঘোল ৬০ টাকা ও মাঠা ৮০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। তবে জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি লিটার ঘোল ১০০ টাকা, মাঠা ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঘোল তৈরির উপকরণ দুধ ও চিনির দাম বাড়ার কারণে এই ঘোলের দাম গতবারের চেয়ে এবার বেড়েছে।
ঘোল বিক্রতা মোঃ রেজাউল বলে কম বেশি প্রতিদিন ঘোল বিক্রি হয়, কিন্তু মাহে রমজান আসলে ঘোল বিক্রির ধুম পরে যায়।
কাঠেরপুল এলাকা থেকে ঘোল কিনতে আসা কবিতা আক্তার বলেন,রোজা রেখে এক গ্লাস সলপের ঘোল পান করে অনেক তৃপ্তি পাই।অন্য জায়গায় তুলনায় সলপের ঘোলের স্বাদে ভরপুর।
গাজীপুর থেকে ঘোল কিনতে আসা শাহিন রেজা, ইমরান হোসেন ও রুহুল আমিন বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, মিষ্টি, দই ও সলপের ঘোল নিয়ে গাজীপুরে বিক্রি করেন। রোজার প্রথম থেকে তারা প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ লিটার ঘোল ও মাঠা এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাই। এই রজমানে ঘোল ও মাঠার বেশ চাহিদা। গরমে রোজা রেখে এক গ্লাস সলপের ঘোল পান রোজাদারকে তৃপ্তি দেয়। সলপের ঘোল ছাড়া যেন আমাদের চলেই না।
জেলার শাহজাদপুর থেকে সলপের ঘোল কিনতে আসা মৌসুমী ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, সলপ থেকে সরাসরি এই ঘোল কিনলে কম দামে পাওয়া যায়। তাই মোটরসাইকেল নিয়ে সলপের ঘোল কিনতে আমি এখানেই চলে এসেছি। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ লিটার ঘোল কিনে নিয়ে যায়।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি আনছার আলী, আমজাত শেখ ও আব্দুল কাদের জানান, এক সময়ে সলপের তৈরি ঘোল ভারতের কলকাতার মানুষের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। ট্রেনে করে প্রতিদিন ঘোল চলে যেত কলকাতায়।
ঘোল বিক্রেতা আব্দুল মালেক জানান, গ্রীষ্ম ও রমযান মাস ছাড়াও বিশেষ বিশেষ দিনে তাদের ঘোলের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাইকারি দরে ঘোল কিনে নিয়ে যান। প্রতিদিনই ঘোলের চাহিদা বাড়ছে বলে জানান ঘোল ব্যবসায়ীরা।
সলপ ঘোল ঘর অ্যান্ড সাদেক খান দই ঘরের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক খান জানান,আমার দাদা সাদেক আলী শত বছর আগে কাজের খোঁজে রাজশাহী যান। সেখানে এক ঘোষের কাছ থেকে ঘোল ও মাঠা বানানো শিখে এসে ১৯২২ সালে সলপ রেল স্টেশন এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রথম দিকে বাড়িতে ঘোল ও মাঠা বানিয়ে স্টেশন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করলেও ধীরে ধীরে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এসে তার তৈরি এই পানীয়ের স্বাদ নিতে শুরু করেন। পরে দাদার মৃত্যুর পর আমার বাবা ও চাচারা এই ব্যবসার হাল ধরে। সেই সূত্র থেকেই বর্তমানে আমরাও দুই ভাই এই সুস্বাদু পানীয় তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়ি।এই ঘোল ঢাকা,ফেনী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা,দিনাজপুর, নওগাঁ, ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জি. শওকত হোসেন জানান, সলপের ঘোলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বৈশাখ মাসে এখানে ঘোলের মেলার আয়োজন করা হয়। সলপের ঘোলের স্বাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঘোল ব্যবসায়ীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার দাবিও জানান এই জনপ্রতিনিধি।
সলপের ঘোলের বিষয়ে সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রাম পদ রায় বলেন, ঘোল বা মাঠা অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি পানীয়। এ পানীতে ক্যালসিয়াম, আয়রণ, ভিটামিন, উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যা শরীরের জন্য ভালো। এটি উচ্চ রক্ত চাপ, কোলেস্টেরল ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, হজমে সহায়তা করে। ক্লান্তি দূর করে প্রশান্তি আনে, মেজাজ ফুরফুরে রাখে। এ কারণে যুগ যুগ ধরে মানুষ এই পানীয় পান করে আসছেন।